“একজন গর্ভবতীর আত্বকথা।”
আমি মা হতে যাচ্ছি।
আরাফের জন্মের সময় এই কথাটা কাউকে বলতে পারিনি। আমার শাশুরি চোখ গরম করে বলেছিল, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ, এসব লজ্জার কথা কাউরে কইতে হয় নাকি?”
প্রথম তিন মাস আমার খুব বমি হত। সে সময় খুব লুকিয়ে আওয়াজ না করে বমি না করলেও তিনি খুব বিরক্ত হতেন।
পেটটা যখন হাওয়া লাগা নৌকার পালের মত হল, তখন গরমে হাফসাফ অবস্থাতেও অনেক ঢেকে ঘিরে থাকতে হত।
সব মিলিয়ে ভাবটা এমন যেন খুব অন্যায় করে ফেলেছি। লোকে জানলে খুব খারাপ ব্যাপার হয়ে যাবে।
অথবা যে ঘটনার মাধ্যমে একটা শিশুর অস্তিত্ব আমার পেটে এলো সেটা খুব খারাপ একটা বিষয়। এবং সেই ঘটনা যে আমার সাথে ঘটেছে সেটা যেন সহজেই কেউ টের না পায়। আর শেষ পর্যন্ত যখন টের পেয়েই যাবে তখন আমার উচিত মুখ লাল করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা।
অথচ আমার ইচ্ছে হতো চিৎকার করে সব্বাইকে জানাই “আমি মা হতে যাচ্ছি গো। শোন তোমরা, এবার আমারো এমন কেউ হবে যাকে আমি ‘আমার’ বলতে পারবো’।
দোকানে বাচ্চাদের যাই কিছু দেখতাম তাই কিনতে ইচ্ছে হত। কিন্তু নিষেধ ছিল, ” আগে থেকে বাচ্চাদের কিছু কিনলে খুব নাকি খারাপ হয়ে যায়’। কার খারাপ, কিসের খারাপ তার কোন মাথা মুন্ডু বলতে পারতো না, তবুও কিচ্ছু কিনতে দিত না।
নিজেকে ভারি অপরাধি লাগতো ফুলে ওঠা পেটটা নিয়ে। গায়ের কাপড় একটু এদিক ওদিক হলেই কত কথা শুনতে হয়েছে।
অথচ, ওখানে আমার সমস্ত সুখের মন্ত্র জমা ছিল।
অনেক চাচি, ফুপু গলা উচিয়ে বলত “বাচ্চা হবার আগ পর্যন্ত একটা মাছি পর্যন্ত টের পায় নাই”।
আমার খুব ইচ্ছে ছিল খোলা পেটের দিকে যে আমি সারাক্ষন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম, তার একটা ছবি যদি কেউ তুলে রাখতো!!
সেটা হয়নি।
গ্রামে আমাদের বাড়ির ওদিকে ১৫ বছর আগেও বলত, ‘কম করে খাবার খাবি, তাহলে ছোট হবে বাচ্চা, ব্যাথা কম পাবি’। এখন সেসব কমেছে।
গোয়ালঘরে বাচ্চা জন্মানর দৃশ্য তো হরহামেশা ঘটেছে একযুগ আগেও। প্রসবের সময় অমানবিক কষ্ট সইতে না পেরে চিৎকার করাকেওও সবাই অন্যায় মনে করে। কত ছিঃ ছিঃ শুনতে হয় প্রসুতিকে এ নিয়ে।
এ বেলা বাচ্চা বিয়ানো তো পরের বেলা কাথা কাপড় ধুতে পুকুর ঘাটে যাওয়া মেয়েদের কপালে সিলমারা ছিল।
এখনো সেই পরিস্থিতি কতটা বদলেছে কে জানে! আমরা তো কুয়োর ব্যাং, যখন যেই পরিস্থিতির কুয়োতে থাকি ভেবে নেই পুরো বিশ্ব বুঝি তেমন ভাবেই চলছে।
শহরে বসে ফেবুর পাতায় নাসার গবেষণা , শিফন শাড়ির ডিজাইন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশের গল্প দেখে দেখে এর বাইরের জগতটা রুপকথা মনে হয়।
আমি মা হতে যাচ্ছি। ইচ্ছে করছে একটা মাইক ভাড়া করে শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এই কথাটা বলে বেড়াই। ইচ্ছে করে সমস্ত শহর আজ সাজিয়ে দেই ফুল দিয়ে। স্বপ্ন দেখি এমন দিনের যেদিন প্রতিটি সন্তান সম্ভবা মা রানীর মত হাটবে এ মাটিতে। তার পথের কাকর সরানোর হাতের অভাব আর হবে না। রাস্তা পাড় করে দেবার জন্য ছুটে আসবে তরুন তরুণীরা। বাসের সিট খালি করে উঠে দাড়াবে যাত্রিরা, বিদ্যুতের বিল পরিশোধের লাইনের সাম্নের মানুষটি ছেরে দেবে তার যায়গা।
না না, এ স্বপ্ন নারী হবার সুযোগ নেয়া নয়। এ স্বপ্ন মা হয়ে এই পৃথিবীকে তার ভবিষৎ উপহার দেবার জন্য প্রত্যাশা।
স্বপ্ন দেখি আমার পল্লীবালা/ বালকের জন্য বরনডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরো পৃথিবী।
সংগৃহীতঃ